রেজাউল হাবিব রেজা,সম্পাদক
আজ ২৪ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে বিদায় জানালো বঙ্গভবন। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় বিদায় জানালো বঙ্গভবন।
আবদুল হামিদ আজ নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের কাছে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর ৪১ দিন রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
বাংলাদেশের গত ৫২ বছরের ইতিহাসে এর আগে বঙ্গভবনে এমন কোনো বিদায় অনুষ্ঠান হয়নি। কারণ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আগে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুল হামিদ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান তখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের ২০ মার্চ তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন।
পরে ২০১৩ সালের এপ্রিলে তিনি ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন।
আজ সকাল ১১টায় বঙ্গভবনের ঐতিহাসিক দরবার হলে শপথ নেন নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। পরে তিনি তার গুলশানের বাসায় যান।
সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল দিয়ে গুলশান থেকে রাত ৮টা ২০ মিনিটে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে পরদিন নতুন রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়া হবে।
এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই বিদায়ী রাষ্ট্রপতি হামিদ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিকুঞ্জে নিজ বাসভবনে চলে যান।
আবদুল হামিদকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) তত্ত্বাবধানে একটি মোটর শোভাযাত্রায় তাঁর নিকুঞ্জের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) একটি চৌকস দল বিদায়ী রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে।
বিদায় অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর একটি ব্যান্ড দল অংশ নেয়।
দুই দলে বিভক্ত বঙ্গভবনের কর্মকর্তারা গাড়ির দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বঙ্গভবনের প্রধান ফটক থেকে বাহিরের গেটের ফোয়ারা পর্যন্ত খোলা জিপে ফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে আবদুল হামিদকে বিদায় জানান তারা।
সেখান থেকে বেলা ০১:৪৫ টার দিকে তাঁকে শেষবারের মতো মোটর শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিকুঞ্জের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়।
মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
আবদুল হামিদ নবম জাতীয় সংসদে স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য আবদুল হামিদ এর আগে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সাতবার সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন।
আজ দুপুরের পর থেকে আবদুল হামিদ ও তাঁর পরিবার তাদের নাগরিক জীবনে ফিরে গেলেন।
এটিই হতে পারে পুরো মোটর শোভাযাত্রায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের শেষ যাত্রা এবং এর পর তাঁকে আবার ট্রাফিক লাইট এবং মোড়ে থামার অভ্যাস করতে হবে।
অপরদিকে অনুষ্ঠিত হয় নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান
মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ মো. সাহাবুদ্দিন চপ্পু আজ সকালে বঙ্গভবনের ঐতিহাসিক দরবার হলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
সকাল ১১টায় রাষ্ট্রপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং শতাধিক বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
এর আগে, কালো মুজিব কোট ও সাদা পাঞ্জাবি পরে নতুন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও স্পিকারকে নিয়ে সকাল ১০টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রবেশ করেন।
সে সময় একটি সামরিক ব্যান্ড আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত পরিবেশন করে।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর নয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অফিসের দায়িত্ব পরিবর্তনের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ নিজ আসন বদল করেন।
পরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শপথ নথিতে স্বাক্ষর করেন।
রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণের পর অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা ও ছেলে আরশাদ আদনান রনিসহ পরিবারের সদস্যরা, এবং বিদায়ী রাষ্ট্রপতি হামিদের পরিবারের সদস্যরা, তাঁর স্ত্রী রাশিদা খানম ও ছেলে ইঞ্জিনিয়ার রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক এমপিসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ডেপুটি স্পিকার, সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম, কাদের, জাতীয় সংসদের হুইপগণ সংসদ সদস্যবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের প্রধান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, প্রতিমন্ত্রী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন বা ইনস্টিটিউটের প্রধানগণ, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মহা পুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি), বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকসহ সিনিয়র সাংবাদিক এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাসহ প্রায় ১১০০ জনেরও বেশি আমন্ত্রিত অতিথি অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করেন।
এর আগে ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়াারি বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ১৯৪৯ সালের ১০ডিসেম্বর পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবিলী ট্যাংক পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম চুপ্পু। পিতা শরফুদ্দিন আনছারী, মাতা খায়রুন্নেসা।
তিনি ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে এলএলবি ও বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
মো. সাহাবুদ্দিন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। জেলা বাকশালের যুগ্ম-সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি পাবনা জেলার আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। ওই সময় সামরিক স্বৈরশাসকদের রোষানলে তিন বছর জেল খাটেন এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন।
মো. সাহাবুদ্দিন দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতাও করেছেন। তাঁর অনেক কলাম বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে।
কর্মজীবনে তিনি জেলা ও দায়রা জজ এবং দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন পরপর দু’বার বিসিএস (বিচার) এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। চাকরি থেকে অবসরের পর হাইকোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন।
পরবর্তীকালে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুদক কমিশনার হিসেবে তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে উঠা তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় দৃঢ়তার পরিচয় দেন।
সাবেক এই ছাত্রনেতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন ২১তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হন।
Leave a Reply